কুশিয়ারার ভাঙনে বদলে যাচ্ছে জকিগঞ্জের মানচিত্র!

স্টাফ রিপোর্টার: কুশিয়ারা নদীর ভাঙনে সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, জনপদ, কৃষিজমি, সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো বিলীন হয়ে গেছে। শত মানুষ বাড়িঘর ও জমি হারিয়ে অন্যের আশ্রয়ে। অব্যাহত ভাঙনে এরই মধ্যে জকিগঞ্জের সীমানা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখানেই শেষ নয়, কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জের দিকে এমনভাবে ঢুকেছে যে, এই উপজেলার মানচিত্রই বদলে গিয়েছে।

অব্যাহত ভাঙনে আগামী কয়েক বছরে জকিগঞ্জ বাংলাদেশের সীমানা থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ‘এখুনি উচ্চ পর্যায়ে উদ্যোগ না নিলে একসময় পুরো জকিগঞ্জ ভারত সীমানার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে,’ বলে দাবি করেছে জকিগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, জকিগঞ্জের পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ। তবে আমরা ভাঙন ঠোকানোর জন্য চেষ্টায় আছি। উচ্চমহলকে জানানো হয়েছে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সিলেটের সুরমা কুশিয়ারা নদীর ভাঙন রোধ ও বন্যা ঠেকাতে বেড়িবাঁধ নির্মাণে মাস দুয়েক আগেও ৪৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হয়। এটির অনুমোদনের অপেক্ষায়। তবে জরুরি ভিত্তিতে বর্তমানে কুশিয়ারা নদীর ভাঙন রোধের জন্য ছয় কিলোমিটার এলাকায় ব্লক বসাতে হবে। এর জন্য ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন।

সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জ। ভারতের বরাক নদী থেকে উৎপন্ন কুশিয়ারা ও সুরমা। কুশিয়ারার ডান তীরে জকিগঞ্জ বাম তীরে ভারতের করিমগঞ্জ জেলা। জকিগঞ্জের অমলসীদ পয়েন্টে বরাক নদী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ সোজা নেমে গেছে কুশিয়ারায়, অপর ভাগ ‘ইউ টার্ন’ নিয়ে সুরমা নাম ধারণ করেছে। বর্ষায় বরাক নদীর ৭০ ভাগ পানি জকিগঞ্জ হয়ে কুশিয়ারায় আর ৩০ ভাগ পানি সুরমায় প্রবাহিত হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, জকিগঞ্জ সীমান্তে বাংলাদেশের বহু জমি ভারতের সীমানায় চলে গেছে। সেই জমি ভারতীয়রা ভোগ করছেন। এলাকাবাসী জানান, কুশিয়ারা ভাঙতে ভাঙতে করিমগঞ্জ থেকে জকিগঞ্জ সীমান্তের এক-দুই কিলোমিটার ভিতরে চলে এসেছে।

কুশিয়ারা তীরবর্তী বাসিন্দরা বলেন, আমাদের ভূমি ভেঙে ভারতের ওপারে চর জেগে উঠছে। এই অবস্থা চলছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই। তখন করিমগঞ্জকে নদী ভাঙন থেকে রক্ষর জন্য সেদিকের তীরে শক্ত গ্রোয়েন নির্মাণ করা হয়। এতে নদীর প্রবল স্রোতের ধাক্কায় জকিগঞ্জ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হতে থাকে জকিগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর তীর ধসে যাচ্ছে। নিঃশব্দে জকিগঞ্জের গ্রাম-জনপদ ক্ষয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, গত কয়েক দিন আগে এলাকাবাসী নদীভাঙন হতে বাঁচার জন্য নদী তীরে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ দোয়া-দরুদ পড়েন এবং আহাজারি করেন। তারা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতের করিমগঞ্জ এলাকায় কুশিয়ারার তীরে বিশাল এলাকা জুড়ে বিভিন্ন জাতের কৃষিজাত পণ্যের চাষ হয়েছে সুপারি গাছের সারি। বিএসএফ নদী তীর জুড়ে চৌকি বসিয়েছে।

সৌদি আরব প্রবাসী জকিগঞ্জের উজিরপুর গ্রামের আবু তাহের বলেন, ‘একসময় আমাদের গ্রামটি কুশিয়ারার অপর তীরে করিমগঞ্জের পাশে ছিল সাঁতার দিয়ে ছেলেরা একসময় ঐ পাড়ে চলে যেত। এখন নদী ভাঙতে ভাঙতে আমাদের বাড়ি চলে এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে শত লোকের বাড়ি নদীতে চলে গেছে। তারা এখন অন্যের দয়ার ওপর বাস করছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ডান তীরে ৪১ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এর মধ্যে ভক্তিপুরে ৫০০ মিটার, মানিপুর বাখরশালায় ৮০০ মিটার, সড়িশাকুভিতে ৭০০ মিটার, শেখ পাড়ায় ২৫০ মিটার, উজিরপুরে ৪০০ মিটার, লক্ষ্মী পাড়ায় ৫৫০ মিটার, সুনপুরে ৪০০ মিটার, সুপ্রাকান্দিতে ৪০০ মিটার, গাগলাজুরে ২০০ মিটার, লোহার মহলে ৩৫০ মিটারসহ ১০টি স্থানে প্রায় ৪ দশমিক ৬০ কি.মি।

জকিগঞ্জ উপজেলায় ‘সীমান্ত নদীর তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চারটি প্যাকেজে সুপ্রকান্দি, মানিকপুর, রারাই সেনাপতির চক, বড় চাউলিয়া ও রহিমপুর নামক স্থানে ১ দশমিক ৮০০ কি.মি. নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের মধ্যে দুটি প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে। অপরটি চলমান। এ ছাড়া ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ার নদীর ডান তীরে ৪১ কি.মি. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুনর্বাসন কাজ ও অতি ভাঙনপ্রবণ এলাকায় নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজের প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে।

Scroll to Top