বেগম রোকেয়া ও নারী জাগরণ

বেগম রোকেয়া ও নারী জাগরণ

নিজস্বেব প্রতিবেদক: বেগম রোকেয়া ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ বঙ্গালী নারীর অন্যতম। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও তিনি অন্য নারীদের প্রতিষঠানিক শিক্ষার সুযোগ ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আজীবন  লড়াই  করে গেছেন্।  কুসংস্কারে নিমজ্জিত একটি অন্সধকার সমাজ ব্যবস্থার ধ্যাবধারনা থেকে তিনি জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছেন।   তিনি ছিলেন নারী জাগরনের অগ্রদূত। নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য পুরুষতান্ত্রিকতার শেকল ভাঙ্গার মানসে এক  অবিস্মরনীয় নাম।  তার পরিবার ছিল রক্ষণশীল। তার জন্মলগ্নে মুসলমান সমাজ ছিল নানাবিধ কুসংস্কারে নিমজ্জিত। তিনি পর্দা প্রথার বিপক্ষে ছিলেন না,কিন্তু পর্দার নামে সমাজে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট । 

তিনি ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে রক্ষণশীল সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে  জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জহির উদ্দিন আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। তার প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন এবং বৈবাহিক সূত্র নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। 

পর্দা ব্যবস্থার বিপক্ষে রোকেয়ার অবস্থান ছিল না বরং পর্দার নামে সামাজিক কুসংস্কারের বিপক্ষে তার বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, পর্দা মানে ঘরে বন্দি থাকা নয়, শিক্ষা থেকে বিরত থাকা নয়। ইসলাম কখনো নারী শিক্ষার বিষয়ে কম গুরুত্ব দিতে বলেনি।

মহানবীদ (সা.) বলেছেন ‘সব মুসলিম নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জন ফরজ’। অপরদিকে মুসলিম নর-নারী উভয়ের জন্যই পৃথক পর্দার বিধান রয়েছে। নিজ নিজ পর্দা মেনে নিজ নিজ শিক্ষা গ্রহণে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পর্দার নামে নারীদের চার দেওয়ালের ভেতরে রাখার যে কুসংস্কার প্রচলন ছিল তা ভেঙেছেন বেগম রোকেয়া।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালী সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক। বেগম রোকেয়ার পূর্বে তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন সামাজিক অবস্থায় অন্য কোন ব্যক্তিত্ব নারীদের উন্মেষ নিয়ে বলিষ্ঠ ও সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি। তাই তাকে আমরা নারী জাগরণের অগ্রদূতরূপে গণ্য করি। বলা যায় বেগম রোকেয়ার জন্মলগ্নে মুসলমান সমাজ ছিল নানাবিধ কুসংস্কারে নিমজ্জিত। তাই রোকেয়ার পিতা নিজে বহু ভাষায় সুপন্ডিত হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন একেবারে রক্ষণশীল। পরিবারের পর্দা প্রথা এতটাই প্রবল ছিল যে, আত্মীয় পুুরুষ তো দূরের কথা বহিরাগত মহিলাদের সামনেও মেয়েদের পর্দা নিতে হতো। নারী শিক্ষার সুযোগ বলতে শুধু কোরান শিক্ষা ও উর্দু শিক্ষাই প্রচলিত ছিল। বাংলা  ও ইংরেজীন শেখা ছিল নিষিদ্ধ। তাই স্কুল-কলেজের আঙ্গীনায় পা বাড়ানোর সৌভাগ্য বেগম রোকেয়ার হয়নি। তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন। তাই রোকেয়ার অদম্য উৎসাহ দেখে তিনি রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে রোকেয়া ও তার বড় বোন করিমুন্নেসাকে গোপনে বাংলা ও ইংরেজী শেখাতেন। তারপর ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্বামী মুক্তমনা ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। তিনি রোকেয়াকে জ্ঞানার্জনে আগ্রহ ও প্রেরণা দেন। তারই উৎসাহে রোকেয়া বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং ধীরে ধীরে সাহিত্য চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯০২ সালে প্রথম ‘পিপাসা’ নামে তার  এক রচনা প্রকাশিত হয় ‘নবপ্রভা’ পত্রিকায়। এ রচনার মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে পুরোপুরি পদার্পণ করেন। রোকেয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা ‘Sultan,s Dream’-এর অনূদিত রূপ সুলতানার স্বপ্ন। এটি একটি নারীবাদী সাহিত্যের মাইলফলক। তার অন্য গ্রন্থগুলো পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস সবই তার সমাজ জীবনের গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত এবং তিনি বার বার তার লেখায় নানাভাবে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাই ফুটিয়ে তুলেছেন। নারী শিক্ষা ছাড়া নারীর মুক্তি হতে পারে না, আর নারীর মুক্তি ছাড়া কখনও একটি সভ্য সমাজ গড়ে উঠতে পারে না, এট তিনি হৃদয় দিয়ে কঠিন বাস্তবতার আলোকে অনুধাবন করেন। তাই তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী যোগাড় করেন, মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে, লেখনীকে আরও বেগবান করে তোলার মাধ্যমে সামাজিক চিত্র তুলে ধরেন। পুরুষশাসিত এ সমাজে নানা রকম নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, কুসংস্কার, অবিচার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, পর্দার নামে অবরুদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য করা এসব বাস্তব কাহিনী ক্রমাগত তাকে আহত করে তোলে, তাই এ অবস্থা থেকে নারী সমাজকে পরিত্রাণের জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। এই ব্যাকুলতাই তাকে দুর্বার করে তোলে, তার চলার পথে নানা রকম বাধা, সমালোচনা তাকে ঘিরে ফেলে, কিন্তু রোকেয়া থেমে থাকেননি। এখানেই রোকেয়ার সফলতা, বরং উনি তার লেখার মধ্য দিয়ে সমালোচনার জবাবও দিয়েছেন। রোকেয়ার সংগ্রাম ছিল মূলত দুই ধরনের, একদিকে ঘুমন্ত নারী সমাজকে জাগিয়ে তোলা। যা তার সুবহে সাদেক প্রবন্ধে প্রকাশ ঘটে। অন্যদিকে, সামাজিক কুসংস্কারমুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। তার এ সংগ্রাম কখনও পুরুষের বিরুদ্ধে ছিল না বরং নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তনই ছিল তার কাম্য। দাসী নং, সহধর্মিণীরূপে, সহযোদ্ধারূপে পাশে রাখাই ছিল তার আহ্বান। তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই। সুব্্হে সাদেক প্রবন্ধে উনি রানীদের উদ্দেশ লিখেছেন-“বল আমরা পশু নই, বল ভগিনী আমরা আসবাব নই, বল কনে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকবার বস্তু নই, সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ!” আমরাও যে মানুষ এটাই বড় সত্য, আর এ বড় সত্যকে সত্যরূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল মূলত রোকেয়ার আমৃত্যু সংগ্রাম ও সাধনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আজ অবধি সমাজের সর্বস্তরে, ঘরে বাইরে নারীকে নারী নয়, মানুষরূপে মূল্যায়ন করার যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে শিক্ষা, যে আচার আচরণ প্রয়োজন তা গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি রোকেয়ার স্বপ্নের সেই মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজ, যে সমাজে আমরাও মানুষ হয়ে উঠব। তাই রোকেয়া দিবস রোকেয়াকে স্মরণকালে এমন এক সমাজ গড়ে তোলাই হোক আজ আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ও কাম্য। তবেই রোকেয়ার মর্যাদা ছড়িয়ে পড়বে সমাজের সর্বস্তরে ।

এ সমাজ কুসংস্কারমুক্ত হোক। সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত হোক। বাল্যবিয়েমুক্ত হোক। নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানে সমান এগিয়ে যাক। জয় হোক এ দেশের সব নারী-পুরুষের। পরিশেষে রোকেয়াকে জানাই আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ।

Scroll to Top