ভাষা আন্দোলনে তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশন

সত্য সংবাদ ডেস্ক:

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের মধ্যে দিয়েই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ঢাকা শহরের সেই আন্দোলন শুরু হলেও এর কিছুটা ঢেউ এসে লাগে মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার পয়লা ইউনিয়নের তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউশনে।

তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউশনে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। স্বর্গীয় প্রমথ নাথ নন্দী তৎকালে হাইস্কুলের কিছু ছাত্রকে ভাষার জন্য আন্দোলন করতে বলেন। তার বাড়িতে ছাত্রদেরকে সংগঠিত করতেন এবং কিভাবে ভাষা আন্দোলন করা যায় সে ব্যাপারে উপস্থিত সকলকে নির্দেশনা প্রদান করতেন উপস্থিত সকলে তার কথায় আরো উদ্ধুদ্ধ হয়ে ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। প্রমথ নাথ নন্দী ছাত্রদের জানান যে মানিকগঞ্জ থেকে অনেকেই আন্দোলন করতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।

প্রমথ নাথ নন্দীর কথায় উপস্থিত ছাত্ররা অনুপ্রাণিত হয়ে আরো অনেক ছাত্রকে এ দলে অন্তুর্ভুক্ত করেন এবং বিভিন্ন মানুষকে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বোঝাতে থাকেন। গ্রামের মানুষদের বোঝাতে থাকে যে পাকিস্তানিরা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে দেবে না আমাদেরকে উর্দু ভাষায় কথা বলতে হবে। তারা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। এতে গ্রামের অন্যান্য মানুষও তাদের দলে যুক্ত হয়। ১৯৪৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের ১ম বা ২য় সপ্তাহে তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউশনের ছাত্র-ছাত্রীরা স্বশরীরে ভাষার জন্য আন্দোলন করে। ধারণা করা হয় ঢাকার পরে আঞ্চলিক পর্যায় এটিই প্রথম ভাষার জন্য আন্দোলন।

সেদিন ঢাকা থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের পাঠানো ডাক বিভাগের মাধ্যমে বেশকিছু লিফলেট আসে তেরশ্রী কে,এন, ইনস্টিটিউশনের ছাত্র রেহাজ উদ্দিনের নামে ওই লিফলেট বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র
ভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহŸান জানানো হয়। লিফলেটগুলো স্কুলের দপ্তরী মনমোহন নবম শ্রেণীর মিরান উদ্দিন হাতে দেয়। মিরান উদ্দিন ছিলেন তখন নবম শ্রেণির মনিটর (ক্লাশ ক্যাপ্টেন)। তিনি তাঁর বন্ধু ওয়াজ উদ্দিনকে সাথে নিয়ে প্রতিটি ক্লাশে লিফলেট বিলি করে এবং সকল ক্লাশে ঘোষণা দিয়ে আসে যে, সবাই যেন ক্লাশ শুরু হবার আগেই ক্লাশ ত্যাগ করে মাঠে চলে আসে এবং তারপর তারা মিছিল করবে। স্কুলে ক্লাশ শুরুর ঘণ্টা পরার আগেই সবাই বেরিয়ে আসে এবং সবাইকে নিয়ে তখন মিছিল শুরু হয় ¯েøাগান ছিলো “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” উর্দু হরফ চলবে না চলবে না।”

সেদিন মিছিলে ছিলো: প্রমথ নাথ নন্দী, মোঃ ওয়াজ উদ্দিন মাস্টার, মিরান উদ্দিন মাস্টার, আব্দুল হালিম মাস্টার, আফসার উদ্দিন মাস্টার, প্রমথ সরকার, ডা. মোবারক আলী, ডা. আব্দুল সালাম, নিবারন চন্দ্র শিকদার, যতীন্দ্রনাথ সরকার, জয়েন উদ্দিন মুন্সী, আব্দুর রহমান ঠাকুর, ভুপেন্দ্রনাথ দাস, মনিন্দ্রনাথ সরকার, নিরঞ্জন সরকার, নিরঞ্জন বিহারী বসু। সিরাজ উদ্দিন মৃধা, মোঃ রেহাজ উদ্দিন এবং নাম না জানা আরো অনেকেই।

মিছিলটি ¯েøাগান দিতে দিতে ঘিওরের দিকে অগ্রসর হয়। ঘিওরের কাছাকাছি গেলেই দেখে যে পুলিশ বন্দুক তাক করে আছে। আর এ কারনে ঐ দিকে আর অগ্রসর না হয়ে মিছিলটি মোড় করে বিভিন্ন
গ্রামের উপর দিয়ে পুনরায় তেরশ্রী কে, এন, ইনস্টিটিউনের স্কুলের মাঠে এসে উপস্থিত হয়। এ সময় মিরান উদ্দিন মাস্টারের লজিং মাস্টার জানান যে, যারা মিছিল করেছে তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ আসছে। এ কথা জানাজানি হবার পর সবাই পালিয়ে গেলেও এ সময় ৪ জন গ্রেফতার হন।
১। মোঃ ওয়াজ উদ্দিন মাস্টার (নবম শ্রেণি)
২। ভুপেন্দ্রনাথ দাস (মেট্রিক পরীক্ষার্থী)
৩। নিরঞ্জন বিহারী বসু (নবম শ্রেণি)
৪। মোঃ রেহাজ উদ্দিন (দশম শ্রেণি)

মূলত রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই মর্মে মিছিল করার জন্য তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতারা তখন তাদের ধরিয়ে দেন। তৎকালীন ঘিওর থানার ওসি চেরাগ আলী ঐ ৪ জনকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার করে তাদেরকে ঘিওর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আব্দুল গণি ও ইসমাইল হোসেন। এই দুজন ব্যক্তিই মূলত ঐ চারজন ছাত্রের নামে অভিযোগ করেন। সেদিন ঐ চারজনকে বলা হয়Ñ তোমরা যদি জবান বন্দি দাও প্রমথ নাথ নন্দীর নির্দেশে তোমরা এই মিছিলটি করেছো তাহলে তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু তারা চারজন তা না বলার কারনে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয় এবং ঘিওর থানা থেকে মানিকগঞ্জ সদর কোর্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোর্ট থেকে জামিন না হওয়ায় তাদেরকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মানিকগঞ্জ কারাগারে তাদের থাকতে হয় ১৬ দিন। মানিকগঞ্জ জেলখানার ভেতরে খাওয়া-দাওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদ করায় ৪ জনকেই ১৬ দিন পরে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বয়সে ছোট হওয়ায় মোঃ ওয়াজ উদ্দিন মাস্টারকে রাখা হয় কথিত ‘ছোকরা ছেলে’। এখানে ১৮ দিনের মাথায় কংগ্রেস নেতা তৎকালীন এমসিএ বিশিষ্ট আইনজীবী ভবেশ চন্দ্র নন্দী তাদেরকে জামিনে মুক্ত করেন। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা খারিজ করা হয়ে যায়। ৩৪ দিন কারাভোগের পর তারা মুক্তি পান।

মুক্তি পেয়েও তারা আন্দোলন থামিয়ে রাখেনি। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করাই যেন ছিলো তাদের একমাত্র লক্ষ্য। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চালিয়েছেন ভাষার লড়াইল।

তাদের এই অবদান অনস্বীকার্য। তাদের এই আন্দোলনের কারনেই তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশন স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায়। ভাষা সৈনিকেরা আমাদের অনুপ্রেরণার নাম। তারা সবাই চলে গেছেন বটে কিন্তু তাঁরা আরো দৃঢ়ভাবে আছেন আমাদের মাঝে এই স্বাধীন বাংলায়। তেরশ্রী কে, এন, ইনস্টিটিউটশনের ভাষা সৈনিকসহ দেশের সকল ভাষা সৈনিক ও শহীদদের প্রতি রইলো বিন¤্র শ্রদ্ধা।

লিখেছেন-
শাহীনুর রহমান
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ, মানিকগঞ্জ।

Scroll to Top