সত্য সংবাদ ডেক্স: মানিকগঞ্জের সুস্বাদু ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়ের রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। এজন্য দেশে-বিদেশে এর নাম ছড়িয়ে পড়েছে। ইংল্যাণ্ডের রাণী এলিজাবেথ এই ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড় খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তবে বর্তমানে ভেজাল হাজারী গুড়ে বাজার সয়লাব।
এখন থেকে সাত পুরুষ আগে এই গুড়ের উদ্ভাবক ছিলেন হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের ঝিটকা এলাকার মোহাম্মদ হাজারী প্রামানিক। তার নামানুসারে এই গুড়ের নাম দেয়া হয়েছিল হাজারী গুড়।মোহাম্মদ হাজারী প্রামানিকের বাড়িটী এখন হাজারী বাড়ি নামে পরিচিত, অনেকে আবার বাড়িটিকে গাছি বাড়ি বলেও থাকেন। তার নামানুসারে এই পাড়াকে সকলেই বলে হাজারী পাড়া বা গাছী পাড়া। এর আদি নাম ছিল শিকদার পাড়া।
ইংল্যাণ্ডের রাণী এই এতিহ্যবাহী সুস্বাদু হাজারী গুড়ে মুগ্ধ হয়ে বাংলায় পিতলের হাজারী লেখা সিল উপহার হিসেবে পাঠিয়ে ছিলেন হাজারী পরিবারে। তখন থেকে হাজারী গুড়ে এই সিল ব্যাবহার করা হয়।
বংশানুক্রমে এই হাজরী গুড় তৈরি করা হয়। বংশের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে ঐ পরিবারের বংশধর শাহেদ হাজারী ও তার ভাই জাহিদ হাজারী এখনও হাজারী গুড় তৈরি করে আসছেন।
হাজারী গুড় তৈরির জন্য একদিনে ২০/২৫ টির বেশি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায় না। এই গুড় তৈরির জন্য একই গাছ থেকে দুইদিন অন্তর অন্তর রস সংগ্রহ করতে হয়। এই গাছগুলো থেকে একদিনে ৪০/৪৫ কেজি রস পাওয়া যায় যা থেকে ৩/৪ কেজি হাজারী গুড় তৈরি করা যায়। হাজারী পরিবারের দুই সদস্য প্রতিদিন গড়ে ৬/৮ কেজির বেশি গুড় তৈরি করতে পারে না। এই গুড় বাজারে বিক্রয় হয় না, বাড়ি থেকে অগ্রিম অর্ডারের মাধ্যমেই বিক্রয় হয়। হাজারী গুড় তৈরি করতে প্রথমেই খেঁজুর গাছ থেকে এর রস সংগ্রহ করতে হয়। এর পর বিশেষ চুল্লীতে (মাটির তৈরি বাইনে) বিশেষ মাটির পাত্রে ( জালা) ৩৫/৪০ মিনিট জ্বাল (তাপ) দিতে হয়। রস কিছুটা গাঢ় হলে মাটি খুঁড়ে বসানো অপর একটি জালায় ঢালা হয়। এরপর কাঠের তৈরি কাঠি ( বিশেষ আকৃতির বৈঠা ) দিয়ে ২০/২৫ মিনিট ধরে একটানা ঘুটলে এর রং সাদা এবং ঘণ হয়। এরপর পাটালী আকৃতির পাত্রের ( বিশেষ আকৃতির মাটির পাত্র) উপর কাপর বিছিয়ে তাতে ঐ গুড় ঢালা হয়। এর ঘণ্টা দেড়েক পর তাতে হাজারী লেখা সিল দিতে হয় । এর আধা ঘণ্টা পর গুড় তোলা হয় অন্য যেকোন পাত্রে। এভাবে হাজারী গুড় তৈরি করা হয়।
কিছু অসাধু গাছিরা একই আদলে খেঁজুরের গুড় তৈরি করে অবৈধভাবে একই রকম ডুব্লিকেট সিল ব্যাবহার করে বাজারজাত করে আসছে। এরা চিনি ও চুন মিশিয়েও নকল গুড় তৈরি করে কম দামে বাজারজাত করছেন। এসব গুড় স্বাদে প্রকৃত হাজারী গুড়ের মত নয়।
ভেজাল হাজারী গুড়ের আধিক্যে আসল হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে ৷ মাঝে মাঝে সংশ্লিষ্টরা ভেজাল গুড় তৈরি প্রতিরোধে অভিযান চালিযে জরিমানা করে সতর্ক করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অসাধু ব্যাবসায়ীরা আবার একই কাজ করছে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিছু খেঁজুর গাছ মারা যাচ্ছে,আর কিছু কাঠ হিসেবে বিক্রয় করা হচ্ছে। এতে ক্রমেই কমছে খেঁজুরের গাছ। নতুন করে কোন খেঁজুর গাছ লাগানো হচ্ছে না। হাজারী গুড় তৈরির কাঁচামাল খেজুরের রস আসে খেঁজুর গাছ থেকে, আর সেই গাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। তাই হাজারী গুড় তৈরির সংকট দেখা দিবে, সেদিন বেশী দূরে নয়।
মানিকগঞ্জ ভোক্তা সংরক্ষণ সংগঠন ক্যাব এর সভাপতি ও মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মোঃ গোলাম ছারোয়ার ছামু জানান, হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে ভেজাল হাজারী গুড় তৈরি প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যাবস্থা নিতে শীঘ্রই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।